অমর শিল্পী তুমি কিশোর কুমার

 

 ‌‌

নিজস্ব প্রতিবেদন: রাজনীতির মঞ্চে তো আজকাল নায়ক গায়ক শিল্পীদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ, এই বাঙালি শিল্পী কিন্তু কোনদিনও রাজনীতির শরণাপন্ন হননি, অন্তত সাফল্যের জন্য। বরং সাফল্যই তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে জীবনভর এমনকি জীবিত থাকার পরেও!

 

ইনিই ভারতের একমাত্র শিল্পী যাকে শেষ করার জন্য দেশের নেতা থেকে ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল উঠে পড়ে লেগেছিল। একমাত্র গায়ক যিনি আজ অব্দি সরকারের থেকে কোনো সম্মান পাননি। আয়কর দপ্তরকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল তাঁর পেছনে, এমনকি আকাশবাণীতে পর্য্যন্ত তাঁর গান বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেপথ্য কন্ঠশিল্পী হিসেবে তাঁকে না নেওয়ার জন্য হুমকি দেয়া হয় সিনেমার প্রযোজক থেকে পরিচালক কে। শাসানো হয় তার গান রেকর্ড করলে নিষিদ্ধ করে দেয়া হবে মিউজিক কোম্পানিকে। তবুও নোয়ানো যায়নি ইস্পাত কঠিন মেরুদন্ডের সেই বাঙালি শিল্পী কে। কি ছিলো তাঁর অপরাধ....... ?


অপরাধ ভীষণ গুরুতর। দেশের অলিখিত এক যুবরাজের দলীয় অনুষ্ঠানে বিনা পয়সায় গান গাইতে রাজি হননি তিনি। ঘাড় বেঁকিয়ে বলেছিলেন "বিনা পয়সায় শোনার জন্য আমার গান নয়!"

শুধু কি তাই, আজ পর্যন্ত এমন কোন সঙ্গীত শিল্পী জন্মালো না, যিনি টপ ফর্মে থাকা কোন নায়ককে মুখের ওপর বলতে পারেন তোমার লিপের জন্য আমি গান দেবোনা! হ্যাঁ, সেটাই বলেছিলেন সেসময়ের বক্স অফিস হিট নায়ক জিতেন্দ্র মিঠুন আর অমিতাভ বচ্চন কে। বেঁচে থাকতে স্ত্রী লীনা চন্দ্রভারকার কে বলেছিলেন, "আমি যখন থাকবো না তখন দেখো লোকে কেমন খুঁজছে আমায় ! আমার কণ্ঠের ঝলক কারুর গলায় পেলে তাঁকে নিয়ে লোকে পাগল হয়ে যাবে, কিন্তু আমায় পাবে না । "


বাস্তবে সেটাই হয়েছিল। কুমার শানু কি সাফল্যের শিখরে উঠতে পারতেন, যদি গলার স্বর তাঁর সাথে না মিলতো? না পেলেন কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান না কারোর সমর্থন, তবুও লড়াই করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে হ্যাঁ , আমি কিশোর কুমার!

বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ৯১ বছর। চলে গেছেন আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগে। এখনও সমান চুম্বক কিশোর কুমারের গানে। এখনও আগের মতো সমান জনপ্রিয় তিনি। তাঁর নামে ভারতবর্ষের যে কোনও প্রান্তে অনুষ্ঠান হোক না কেন, সিট ফাঁকা পড়ে থাকে না! যত মাধ্যম আছে সব জায়গায় তাঁর গান হিট।


মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে একবার মান্না দের জন্য পুজোর গান তৈরি করলেন।‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যে দিন যাবে।’’ গান শুনে মান্না বললেন, ‘কী করেছেন মশাই! আমার মরণযাত্রা করিয়ে দিয়েছেন! এই গান আপনাদের বৌদি গাইতে দেবে না!” দু’জনেই খুব ভেঙে পড়লেন! কিন্তু মান্না দে-কে কিছুতেই রাজি করানো গেল না! কিছু দিন বাদে পরিচালক মনোজ ঘোষ তৈরি করলেন, ‘তুমি কত সুন্দর’। ছবিটিতে মৃণাল পুলক গান তৈরি করলেন। ‘তোমার বাড়ি...’ গানটা শুনে পরিচালকের পছন্দ হয়ে গেল। বললেন, এই ছবির জন্য গানটা তাঁর চাই। মান্নাদার জন্য তৈরি গান কে গাইবে? সকলেই একমত, এই গান গাওয়ার মতো এক জনই আছেন, তিনি কিশোর কুমার।


মনোজ ঘোষ ও মৃণাল রওনা দিলেন মুম্বই। গান কিশোরকুমারের খুব পছন্দ হল। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। গানে একটা লাইন ছিল,‘তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকো...।’ কিশোর কুমার বেঁকে বসলেন। গানের মধ্যে বারান্দা চলবে না।“পুলকবাবুকে বলে ওটাকে 'আঙিনা' করে দাও।” দু'জন পড়লেন মহা বিপদে। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। পুলক বাবুকে কিছুতেই ধরা গেল না। আর তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে শব্দ বদল করার সাহস কারও নেই! এ দিকে আবার কথা না বদলালে কিশোর গাইবেন না! শাঁখের করাত। 


রেকর্ডিংয়ের দিন কিশোর এলেন। সিরিয়াস গান, ডুবে গেলেন গানের মধ্যে। গান শুরুর আগে ডাকলেন মৃণালকে। মৃণাল তো নিশ্চিত, এ বার বলবেন, “কথা চেঞ্জ হল?” আর তার পরই রেকর্ডিং বন্ধ! কিন্তু কী কাণ্ড! কিশোর কুমার বললেন, “বড় ভাল সুর করেছ মৃণাল।” তারপর ‘বারান্দা’ শব্দ সমেত গাইলেন গানটা। আর ওই প্রসঙ্গে গেলেন না। তৈরি হল কালজয়ী এক বাংলা গান।


জন্ম ১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়াতে। বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী ছিলেন উকিল। পিতৃদত্ত নাম আভাস কুমার গাঙ্গুলী। চার ভাই বোনের ভিতর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সবথেকে বড় ছিলেন অভিনেতা অশোক কুমার। তাঁর ছোটবেলাতেই দাদামণি অশোক কুমার বোম্বেতে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে বড় সাফল্য পান। এই সফলতা ছোট্ট কিশোরের উপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিখ্যাত গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের একজন বড় ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। সায়গলের গাওয়া গানগুলো নকল করে গাইতেন, যদিও তার গানের কোন ধরাবাঁধা শিক্ষা ছিল না।


প্রাথমিক অবস্থায় তিনি কুন্দন লাল সায়গলের নকল করে গাইতেন। পরে শচীন দেববর্মনের পরমর্শে নিজের গাইবার কায়দা পাল্টান এবং এমন এক গায়কি উদ্ভাবন করেন যা সেই সময়ের অপর প্রধান দুই গায়ক মহম্মদ রফি এবং মুকেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল গলাকে ভেঙে গান গাওয়া যা আগে কখনও শোনা যায়নি। এই কায়দা ভীষণ জনপ্রিয় হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কমেডি নায়ক হিসাবে জনপ্রিয় হন। আর ষাটের দশকে তিনি হয়ে উঠলেন প্রবল ব্যস্ত এক সফল নায়ক এবং গায়ক। এছাড়া তিনি সুরকার, গীতিকার এবং প্রযোজকের ভূমিকাও পালন করতে লাগলেন। একাধারে এত প্রতিভার বিকাশ না কখনো আগে দেখা গেছে, না পরে। তাইতো যতদিন গান থাকবে তত দিন কিশোর কুমারের নাম থেকে যাবে মানুষের হৃদয়ে ॥ 


Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গ গৌরব উৎসব সম্মান পেলেন মৌসুমী দাস

বেলঘরিয়া থানার পুলিশের উদ্যোগে উদ্বার বেআইনি একাধিক স্কুটি

সমাজ সেবা করাই নেশা নীলকণ্ঠের