*I was a fighter , one more fight , the last  the best*

নিজস্ব প্রতিবেদন,কলকাতাঃ  ---- " না যোদ্ধার লড়া হয়নি শেষ যুদ্ধ।সৈন্যদল প্রস্তুত , সেনানায়কও প্রস্তুত কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের তৎপরতায় পিছিয়ে যায় আক্রমণ। যুদ্ধ হয় , লড়াই হয় .. কিন্তু সেই যুদ্ধ হয় ভারত মাতার আর এক প্রিয় সন্তান নেতাজির নেতৃত্বে। নিজেই তুলে দিয়েছিলেন নেতাজির হাতে দায়িত্ব ? নাকি ... জাপানি সামরিক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে ? নাকি .... মোহন সিং এর কি কোনো ভূমিকা ছিল ? জানা নেই । পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন তথ্যে ভরা ইতিহাস। তার আত্মীয়রা যা লিখেছেন , সেটুকু ছাড়া বাকি ইতিহাসের সব তথ্যই অত‌্যন্ত কম। খুব বেশি কিছু জানা যায় না তাঁর সম্পর্কে। কি বলা যায় দেশের এক শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি উদাসীনতা ? অবহেলা

ইতিহাসেও উপেক্ষিত , নিজ জাতি ও দেশের কাছেও চরম উপেক্ষিত অগ্নিযুগের বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। শুধু বিপ্লবী নন , একই সাথে তুখোড় অভিনেতা এবং বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণে পটু। বারংবার নাস্তানাবুদ করেছেন ব্রিটিশদের । জীবনে মাত্র একবার গ্ৰেফতার হয়েছিলেন। প্রমাণের অভাবে ছাড়াও পেয়ে যান। আর কোনোদিন এই বিপ্লবীকে ধরতে পারেননি ব্রিটিশ পুলিশ । কখনো চাকর , কখনো মালি , কখনো দেহাতি সেজে বোকা বানাতেন। 

শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা পুরো পুলিশে ঘেরা। চলছে খানা তল্লাসি। কিন্তু রাসবিহারী কোথায় ? শিয়ালদহ পোস্ট অফিসের সামনে একমনে বসে বেহালা বাজিয়ে গেল একজন আংলো ইন্ডিয়ান । মুখে মুচকি হাসি। উনিই রাসবিহারী। 
বেনারসে বাড়ি ঘেরাও । বেরিয়ে এল বৃদ্ধ উড়ে ঠাকুর। দেখিয়ে দিল রাসবিহারীর ঘর । কিন্তু ঘর ফাঁকা। রাসবিহারীও নেই , উড়ে ঠাকুরটিও নেই। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে চন্দননগরে বাড়ি ঘেরাও। মাছিও গলবে না , অথচ রাসবিহারীকে পাওয়া গেল না। কিন্তু কিভাবে
পুলিশের খেয়াল হলো একটু আগেই ময়লা মেখে , ঝাঁটা , বালতি হাতে ঝাড়ুদার সেজে বেরিয়ে গিয়েছে মোস্ট ওয়ান্টেড বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। হাসতে হাসতে ব্রিটিশদের বোকা বানিয়ে নাস্তানাবুদ করতেন তিনি ।

বিনোদবিহারী বসু এবং ভুবনেশ্বরী দেবীর সন্তান মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু ১৮৮০ সালের ২৫শে মে পশ্চিম বর্ধমানের সুবলদহ গ্ৰামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিনোদবিহারী বসু ভারত সরকারের প্রেসে উচ্চপদস্থ কর্মচারী । তিনি ছিলেন মানবদরদী সমাজসেবক। গোপনে বিপ্লবীদের সহযোগিতা করতেন তিনি। এহেন পিতার সন্তান রাসবিহারীর দেশপ্রেম ছিল মজ্জাগত। 
ইংরেজি ও ফার্সি প্রতি প্রবল অনুরাগ ছিল রাসবিহারী বসুর। বাল্যকাল থেকে তিনি ইংরেজি ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করতেন। যা তৎকালীন পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো। স্কুলে পড়াকালীন এক বন্ধুর সূত্রে আসেন শ্রীঅরবিন্দের সংস্পর্শে এবং নিজেকে দেশের সেবায় অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন। 

১৯০৮ সালে বড়লাটকে লক্ষ্য করে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি বোমা নিক্ষেপ করেন। এরপর খানাতল্লাসিতে পুলিশ রাসবিহারী বসুর হাতে লেখা দুটি চিঠি উদ্ধার করে এবং তাঁকে গ্ৰেফতার করে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মুক্তি পান। এই প্রথম এবং এই শেষ। আর কোনদিন পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি।

ঠিক এমন সময় আর এক দেশপ্রেমিক " শশীভূষণ রায় " রাসবিহারী বসুকে রক্ষা করতে তার নিজের শিক্ষকতার চাকরিটি তাঁকে দিয়ে দেরাদুনে পাঠিয়ে দেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলা ও বাইরের রাজ্যের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগসূত্র ও সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। 
বাইরে প্রভুভক্ত সরকারি চাকুরে নিপাট নিরীহ মানুষের মতো থাকলেও ভেতরে তিনি ছিলেন ব্রিটিশদের ঘুম কেড়ে নেওয়া বিপ্লবী ‌। পরবর্তীতে তিনি চন্দননগরকে গুপ্ত সশস্ত্র কর্মকাণ্ড , আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা তৈরির কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। 

১৯১৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর। হাতির পিঠে চড়ে  দিল্লিতে প্রবেশ করছেন লর্ড হার্ডিঞ্জ ।প্রবেশ করতেই তীব্র বিস্ফোরণ। মৃত্যু না হলেও হার্ডিঞ্জের পিঠে ঢোকে শেল ও তার পরিচারকের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। দিল্লির আক্রমণ ব্যর্থ হয়। তদন্তে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উঠে আসে ২৭ বছরের বাইরে চূড়ান্ত ব্রিটিশ অনুগত রাসবিহারীর নাম। স্তম্ভিত হয়ে যায় ব্রিটিশ প্রশাসন। তৎকালীন সময়ে বারো হাজার টাকা মাথার দাম ধার্য হয় তাঁর।হুলিয়া বের হয় তাঁর বিরুদ্ধে। 

এই অবস্থাতে তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করেন ও গণ অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করতে থাকেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি গণ অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু কৃপাল সিং বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলে দিন পাল্টে দু দিন এগিয়ে ১৯শে ফেব্রুয়ারি গণ অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়া হলেও ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ কৃপাল সিং ও অন্যান্য গুপ্তচরদের সাহায্যে তা ব্যর্থ করে দেয়। 

আবারও ছদ্মবেশ ধারণ করেন। এবার নোবেল জয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুরের ছদ্মবেশে পুলিশের সামনে দিয়েই পালিয়ে যান জাপান। 

"ইনদো শিশি ", জাপানী ভাষায় ভারতীয় বীরপুরুষ - এই নামেই তাঁকে চিনত সাধারণ জাপানী জনতা।


১৯১৮ সালে রাসবিহারীর সুরক্ষার জন্য তাঁর আশ্রয়দাতা সোমা দম্পতির বড় মেয়ে তোশিকোকে বিয়ে করতে রাসবিহারীকে উৎসাহিত করেন জেনোশা পার্টির প্রভাবশালী নেতা মিৎসু ওয়ামা । বিয়ে হয়। এই বিয়ের ফলে ১৯২৩ সালে রাসবিহারী পান জাপানী নাগরিকত্ব। 

১৯৩৩ সালে রাসবিহারী বসু জাপানে প্রথম ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগের আয়োজন করেন। উদ্দেশ্য " যে কোনো মূল্যে স্বাধীনতা " । এতে যোগ দেয় ভারতীয় ছাত্ররা ও স্থানীয় ভারতীয়রা। লীগ জনপ্রিয়তা ও ব্যাপকতা এবং রাসবিহারী হয়ে ওঠেন পুরো পূর্ব এশিয়ায় এই আন্দোলনের নেতা। 
১৯৪২ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি মালেশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা জাপানীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বন্দি ভারতীয় সেনাদের নিয়ে একটি ভারতীয় সেনা গঠনে উদ্যোগী হন ফুজিয়ারা । 
রাসবিহারী বসুর হাতে তুলে দেওয়া হয় এই ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব (INA)  
বন্দি সেনা , স্থানীয় ভারতীয় এবং জাপানী সেনার মিশ্রণে রাসবিহারী গড়ে তোলেন সম্পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুত ফৌজ। 
বয়সের ভারে ক্লান্ত  হয়ে পড়েছিলেন এই কর্মবীর । তাঁর আহ্বানে ১৯৪৩ সালের ২ জুলাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে পৌঁছোন। ১৯৪৩ সালের ৪ঠা জুলাই নেতাজির হাতে INA এর দায়িত্ব তুলে দেন রাসবিহারী। 
মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর স্বপ্ন , শ্রম ও ত্যাগের ওপর ভিত্তি করেই নেতাজি গড়ে তোলেন "আজাদ হিন্দ ফৌজ"। 
১৯৪৫ সালের ২১শে জানুয়ারি ভারতের স্বাধীনতা লাভের আগেই মারা যান এই উপেক্ষিত ছদ্মবেশী মহাবিপ্লবী। স্ত্রী তোশিকোর সাথেই সমাহিত করা হয় তাঁকে। 
তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। মৃত্যুর পর জাপান সম্রাট , রাসবিহারী বসুকে , "  Second order of merit of the Rising Sun " সম্মানে ভূষিত করেন। আজও সাধারণ জাপানী জনতা চেনে , জানে , শ্রদ্ধা করে রাসবিহারী বসুকে। তিনি ছিলেন তাদের কাছে "টেনারাই" অর্থাৎ"স্বর্গীয় সত্তা "।
আসুন আমরাও প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই এই "চির উপেক্ষিত স্বর্গীয় সত্ত্বাকে "‌। যাকে, উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা আমরা দিতে পারিনি।
- ঐক্যযোদ্ধা অভিজিৎ গুহ নিয়োগী



Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গ গৌরব উৎসব সম্মান পেলেন মৌসুমী দাস

বেলঘরিয়া থানার পুলিশের উদ্যোগে উদ্বার বেআইনি একাধিক স্কুটি

সমাজ সেবা করাই নেশা নীলকণ্ঠের