মনসা দেবীর পুজোয় ভক্তিতেই মুক্তি

 

ঈশানী মল্লিক, মদনপুর: গত কয়েক দিন আগেই মনসা মায়ের পুজো সম্পন্ন হল। আবারও আগামী বিশ্বকর্মা পুজোর সময় মা মনসার পুজো আসছে। এছাড়া সারা বছরই এই দেবীর পুজো করা হয়। পুজোর আগে এই পুজোর মাহাত্ম্য রইল।

মনসা দেবী হলেন লোকবিশ্বাসের এক প্রাচীন দেবী, যিনি সাপের দেবী হিসেবে পরিচিত। বাংলার লোককথা, মঙ্গলকাব্য ও গ্রামীণ আচার-অনুষ্ঠানে মনসা দেবী বিশেষভাবে পূজিত হন। দেবী মনসাকে সাধারণত সাপের আভাসে বা মাথায় ফণাযুক্ত সাপসহ চিত্রিত করা হয়। তাঁর পূজা মূলত সাপের দংশন থেকে রক্ষা, পরিবার ও সন্তানের মঙ্গল, কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধি এবং বংশবৃদ্ধির আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়।

মনসা পূজার ইতিহাস


প্রাচীন শিকড়:

মনসা দেবীর পূজা আর্য-অনার্য যুগের মিলিত প্রভাবে গড়ে উঠেছে। গ্রামীণ সমাজে যেখানে সাপের উপদ্রব ছিল প্রবল, সেখানে সাপদেবীকে রুষ্ট না করতে বা সাপের ভয় থেকে রক্ষা পেতে এই পূজা শুরু হয়।


মঙ্গলকাব্যে মনসা:

মনসামঙ্গল কাব্য (বিপ্রদাস, বিজয় গুপ্ত, নারায়ণ দেব প্রমুখ কবিদের রচনা) মনসা দেবীর কাহিনীকে জনপ্রিয় করে তোলে।

কাহিনীতে বলা আছে, বেহুলা-লখিন্দর ও চাঁদ সদাগরের কাহিনী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করতে অস্বীকার করেন, তাঁর ছেলে লখিন্দর সাপের কামড়ে মারা যায়। পরে বেহুলার ভক্তি ও সাধনার ফলে মনসা দেবীর পূজা প্রতিষ্ঠা পায়।

এর মাধ্যমে সমাজে মনসা পূজার গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।


চাঁদ সদাগরের অহংকার

চাঁদ সদাগর ছিলেন চরম শিবভক্ত এবং ধনী বণিক। তিনি মনসা দেবীর পূজা করতে অস্বীকার করেন। কারণ, তিনি মনে করতেন মনসা দেবী সমাজে পূর্ণ মর্যাদা পান না, আর তিনি কেবল শিবের পূজাই করবেন। মনসা দেবী এতে ক্রুদ্ধ হন এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে চাঁদ সদাগরকে তিনি বাধ্য করবেন তাঁর পূজা করতে।


লখিন্দরের মৃত্যু

চাঁদ সদাগরের সাত পুত্র ছিল। মনসা দেবী তাঁর ছয় ছেলেকে সাপের কামড়ে মেরে ফেলেন। বাকি থাকে শুধু কনিষ্ঠ পুত্র লখিন্দর।

চাঁদ সদাগর ছেলের বৌভাতের সময় বিশেষ এক লোহার মশারি (লোহার ঘর) তৈরি করেন, যাতে সাপ ঢুকতে না পারে। কিন্তু দেবীর ইচ্ছায় বাসুকী নাগ (মনসার দূত) ফণার ফাঁক দিয়ে ঢুকে লখিন্দরকে দংশন করে মেরে ফেলে।


বেহুলার অদম্য সাধনা

লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। তিনি মৃত স্বামীকে ভেলায় শুইয়ে গঙ্গার স্রোতে ভাসিয়ে দেন এবং দেব-দেবীর কাছে স্বামীর প্রাণ ফেরানোর জন্য তপস্যা শুরু করেন। বেহুলার ভক্তি, ধৈর্য ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি দেবলোক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তিনি দেব-দেবীদের সন্তুষ্ট করেন।


মনসার বিজয়

বেহুলা মনসা দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন স্বামীকে জীবিত করার জন্য। অবশেষে মনসা রাজি হন, তবে শর্ত রাখেন যে চাঁদ সদাগর তাঁকে পূজা করবেন।

বেহুলা শ্বশুরকে রাজি করান। চাঁদ সদাগর অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক মুঠো দূর্বা ও ফুল দিয়ে মনসা পূজা করেন।

ফলে মনসা দেবী প্রসন্ন হন এবং লখিন্দরকে জীবিত করে তোলেন।


কাহিনীর শিক্ষা


১. দেব-দেবীর প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস যে কোনো বাধা অতিক্রম করতে পারে।

২. বেহুলার চরিত্রে স্ত্রীর ভক্তি, ধৈর্য, সাহস ও প্রেমের প্রতীক রূপে চিত্রিত হয়েছে।

৩. সমাজে মনসা পূজার প্রচলন ও গ্রহণযোগ্যতা এই কাহিনীর মাধ্যমেই স্থায়ী রূপ পায়।

সেই থেকেই বাংলায় গ্রামীণ সমাজে মনসা পূজা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আজও বর্ষাকালে দেবীকে পূজা করে সাপদংশনের ভয় থেকে রক্ষা, পারিবারিক মঙ্গল ও সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়।


 লোকজ ধারায় বিস্তার:

বাংলার নদী তীরবর্তী অঞ্চল, বিশেষত নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর, বীরভূম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় মনসা পূজা গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। গ্রামবাংলার মহিলারা বিশেষ করে এই পূজার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত।


মনসা পূজার নিয়মকানুন

মনসা পূজা সাধারণত ঘরোয়া বা স্থানীয় আচারভিত্তিক। নিয়মাবলি অঞ্চলভেদে কিছুটা পরিবর্তিত হয়, তবে মূল দিকগুলো হলো—


১. পূজার সময়:

মূলত বর্ষাকালে (আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে) মনসা পূজা প্রচলিত। বিশেষ করে নাগপঞ্চমীতে মনসা দেবীকে পূজা করা হয়। কিছু অঞ্চলে সারা বছর ঘরোয়া ভাবে পূজা চলে।

২. পূজার স্থান:

ঘরের উঠোনে, পুকুর ঘাটে, বট বা কাঁঠাল গাছের নীচে, কখনও গ্রামীণ মন্দিরে। অনেক সময় মাটির তৈরি মনসা ঘর বানিয়ে সেখানে দেবীর প্রতিমা বা ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়।


৩. উপকরণ:

ঘট (জলপূর্ণ), হলুদ, সিঁদুর, ধূপ, প্রদীপ, দুধ, ডাব, শস্যদানার পূর্ণ পাত্র।

দেবীর প্রতীক হিসেবে মাটি, বাঁশ বা পাটখড়ির প্রতিমা বা পটচিত্র ব্যবহার করা হয়।

সাপের প্রতীক হিসেবে কলা গাছের কাণ্ড বা বাঁশের প্রতিমা রাখা হয়।


৪. পূজার আচার:

উপবাস বা নিরামিষ ভোজন পালন করা হয়। পূজার সময় মনসামঙ্গল কাব্যের পাঠ করা হয়। মন্ত্রোচ্চারণ, ঢাক-কাঁসার আওয়াজ, আরাধনা ইত্যাদি হয়। প্রসাদ হিসেবে দুধ, কলা, ফুল, শস্য, পায়েস ইত্যাদি দেওয়া হয়।


অনেক সময় দেবীর সামনে বলি দেওয়ারও প্রচলন ছিল (বিশেষত অজপালিত ছাগল বা কবুতর), যদিও বর্তমানে অধিকাংশ স্থানে এটি নিষিদ্ধ।


৫. সামাজিক দিক:

নারীরা বিশেষভাবে এই পূজার আয়োজন করে থাকেন।

পারিবারিক মঙ্গল, সন্তানের দীর্ঘায়ু ও সাপের ভয় থেকে রক্ষা কামনা করা হয়।


সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

মনসা পূজা কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি লোকসংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পূজার মাধ্যমে বাংলার সমাজে নারীর ভক্তি, সংসার রক্ষার দায়িত্ববোধ এবং লোককথার ঐতিহ্য সংরক্ষিত হয়েছে। সাপ ও প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক, ভয় এবং সহাবস্থানের দার্শনিক প্রতিফলন এই পূজায় দেখা যায়।

অর্থাৎ, মনসা পূজা বাংলার এক প্রাচীন ও লোকজ ঐতিহ্য, যা সাপদংশন থেকে রক্ষা, পারিবারিক মঙ্গল ও কৃষিজ সমৃদ্ধির কামনায় প্রচলিত। এর ইতিহাস মনসামঙ্গল কাব্য ও বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনীতে গভীরভাবে প্রোথিত, আর পূজার নিয়ম কানুন অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্যময় হলেও মূলত ভক্তি, উপবাস ও লোকজ আচার-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।


মনসা পূজার মন্ত্র


মনসা পূজায় সাধারণত সহজ লোকমন্ত্র ব্যবহৃত হয়। অঞ্চলভেদে মন্ত্রের রূপ ভিন্ন হতে পারে। কিছু প্রচলিত মন্ত্র হলো—


১. বিনয় মন্ত্র

ওঁ মনসাদেব্যৈ নমঃ


২. সাপ দংশন থেকে রক্ষার মন্ত্র

ওঁ হ্রীং মনসাদেবী,

সর্বনাগেশ্বরী পূজিতা ভবা।

সর্বদা সাপদংশনম নাশয় নাশয় স্বাহা॥


৩. প্রতিষ্ঠা মন্ত্র (ঘট স্থাপনের সময়)

ওঁ অষ্টনাগসহিতায়ৈ মনসাদেব্যৈ নমঃ


মনসা ভক্তিগীতি


মনসা পূজার সময় গ্রামীণ মহিলারা ভক্তিগীতি গেয়ে থাকেন। এসব গান সাধারণত সরল ছন্দে, ঢাক-কাঁসার তালে পরিবেশিত হয়।


উদাহরণ (লোকগীতি ধাঁচে):


মনসা মায়ে সাপের রানী,

রক্ষা করো মোরে জনম জনমে।

গৃহে দংশন নাই আসুক,

শিশু-সন্তান মঙ্গল হোক।।


আঞ্চলিক গান (মনসামঙ্গল গীতি)

মনসামঙ্গল কাব্যর অংশ গাওয়া হয় আঞ্চলিক ঢঙে। এ গানগুলো সাধারণত "বেহুলা-লখিন্দর" কাহিনীকে কেন্দ্র করে রচিত।


একটি প্রচলিত গান ধারা এমন—


শুন গো মানুষ, মন দিও,  

মনসার মহিমা কহি।  

চাঁদ সদাগর দিল না পূজা,  

লখিন্দর গেল সাপ দংশি।।


এছাড়াও ভেলায় বেহুলা ভেসে যাওয়ার দৃশ্যকে ঘিরে বহু বেহুলা গীতি প্রচলিত আছে। এগুলোকে বাংলার গ্রামীণ নাট্যধারা বা পালাগানের অংশ হিসেবেও পরিবেশিত করা হয়।


সাংস্কৃতিক দিক মনসা পূজার গান কেবল ভক্তিসংগীত নয়, এটি লোককথা, নাটক ও নৃত্যরূপেও পরিবেশিত হয়। কিছু অঞ্চলে (যেমন মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূম) রাতভর পালাগান হয়, যেখানে মনসামঙ্গল কাব্য গাওয়া হয়। এতে দেবী পূজার পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য, কাহিনীভিত্তিক নাট্য ও সঙ্গীতশিল্প একসঙ্গে মিশে গেছে।


কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। এই মনসা মায়ের পুজো ও ভক্তির মাধ্যমে বহু মানুষ জীবনে উপকার পাচ্ছেন। কেউ হারানো সম্পত্তি ফিরে পাচ্ছেন, কারোর কাজ নেই, সংসার চলছে না; তিনিও মুক্তি পাচ্ছেন। এমন হাজারো মানুষের বিভিন্ন সমস্যা, রোগ, ব্যাধি মা মনসার কৃপায় ভক্তিতে মুক্তি লাভ হচ্ছে। আর এই মনসা মায়ের প্রতিনিধি হয়ে মানুষের সেবায় এই কাজ বহু মানুষই করছেন। যাদের মধ্যে সুমিত্রা সাহা উল্লেখযোগ্য। তিনি মায়ের সেবা করেন এবং মায়ের আদেশ মতোই ভক্তদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। 

Comments

Popular posts from this blog

আমরা ব্যতিক্রমী সংস্হার উদ্যোগে জাতীয় চিকিৎসক দিবস উদযাপন

খুঁটি পুজোয় বাজল পল্লীশ্রী সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির ঢাক