*আজ বাংলা জাতীয়তাবাদের অন্যতম জনক বাঙালি জাতির মহীরুহ শ্রী শরৎচন্দ্র বসুর জন্মদিবস *
" জানকীনাথ বসুর পুত্র ও সুভাষচন্দ্র বসুর মেজ দাদা শরৎচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৯ সালের ৬ই সেপ্টেম্বরে। শরৎচন্দ্র বসু ছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী, বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ এবং ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিশিষ্ট নেতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ও আইন পাশ করে কিছুদিন ওকালতি করেন। পরবর্তীকালে তিনি ইংল্যান্ডে যান ব্যারিস্টারি পড়তে। ১৯১৮ সালে দেশে ফিরে আসেন ব্যারিস্টারি পাশ করে।
দেশে ফিরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনৈতিক জীবনিদর্শনে আসেন। শুরু করেন নিঃস্বার্থভাবে দেশসেবার কাজ। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। এর ফলে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার তাঁকে জেল-জুলুমের অত্যাচার সহ্য করতে হয়।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় মহাসভার সদস্য, কেন্দ্রীয় আইনসভার বিরোধী দলের নেতা, এবং স্বাধীন ভারতের মন্ত্রী পরিষদের এক বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীন ভারতের এক উপনির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা সদস্য পদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরোধিতা করার পাশাপাশি ১৯৪৭ সালে বাংলাকে এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে উনি সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি পরবর্তীকালে সোস্যালিসট রিপাবলিকান পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৩৬ সালে তিনি বেঙ্গল কংগ্ৰেসের সভাপতি হন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৪ সাল অবধি উনি কংগ্ৰেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন।
একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবে শরৎচন্দ্র বসু বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি সমাজ ও ভাষার ভিত্তিতে গঠিত ও শাসিত সমাজতান্ত্রিক রাজ্যের সমন্বয়ে একটি অখন্ড ভারতবর্ষ গঠনের পক্ষে ছিলেন। তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে এই বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারার অনেক মিল ছিল। উভয় নেতা পরবর্তীকালে এক হয়ে এক অখন্ড বাংলা গড়ার সংকল্প নিয়ে এক হয়ে কাজ করেন।
বাংলা ভাগ বা অখন্ড বাংলা - কোনটা ঠিক সেই বিষয়ে আজ যাব না। তবে উনার প্রস্তাব তৎকালীন দিল্লীর কংগ্ৰেসের শীর্ষ নেতৃত্ব যে খারিজ করে দেয় তা বলাই বাহুল্য। তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাধারার ফসল তুলতে যে তৎকালীন কংগ্ৰেস নেতৃত্ব যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-দের মত কিছু কতিপয় মানুষ যারা বঙ্গভঙ্গের হয়ে সওয়াল করেছিলেন , তারা এই বঙ্গভঙ্গের ঘটনাটিকে অতি প্রয়োজনীয় এবং এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখিয়ে নিজেদের ভাগে কৃতিত্ব আনতে চান। কিন্তু তৎকালীন কংগ্ৰেস পার্টির আমলে শ্যামাপ্রসাদ এর মত ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছিল নিতান্তই নগন্য। বাংলা ভাগ আটকাতে শরৎচন্দ্র বসুর ভূমিকা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উনার মতামতকে কোনো ভাবে আমল না দিয়ে শেষ অবধি বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তই গৃহীত হল। শরৎচন্দ্র বসু মনে প্রাণে একজন দেশপ্রেমিক ও সমাজতান্ত্রিক ছিলেন। উনি স্বপ্ন দেখতেন এক অখন্ড বাংলার যার রাজনীতিতে বাংলার ভূমি সন্তানদের এক অগ্ৰণী ভূমিকা থাকবে। উনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বাধীন বাংলার সংবিধান রচনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন যে সংবিধান সমিতির ৩০ জন সদস্যের মধ্যে ১৬জন মুসলমান এবং ১৪জন হিন্দু থাকবেন। মন্ত্রিত্বে হিন্দু এবং মুসলমান সমসংখ্যক থাকবেন আর স্বাধীন অখন্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলিম আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হল না।
শরৎচন্দ্র বসু প্রকৃত অর্থেই ছিলেন এক দেশপ্রেমিক। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালি যেন কোনোভাবেই তাঁর স্বতন্ত্রতা না হারায়, কখনও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাপটে যেন পিছনের সারিতে না চলে যায়। তাঁর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে তিনি বাঙালি জীবনের বঙ্গভঙ্গের যন্ত্রণা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু সুকৌশলে তাঁকে উপেক্ষা করে , তাঁর মতামতকে ধর্তব্যের মধ্যে না রেখে হিন্দীভাষীদের মুখপাত্র তৎকালীন কংগ্ৰেস সরকার যে সিদ্ধান্ত নিল তা পরবর্তীকালে বাঙালিদের জীবনে নিয়ে এল এক চরম দুর্দশা। আজও শরৎচন্দ্র বসুর নামে একটি রাস্তা এক মূর্তি এবং নেতাজি বিষয়ক কিছু গ্ৰন্থে তাঁর উল্লেখ ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। বাংলার এই দেশপ্রেমিক কৃতি সন্তানের প্রতি রইল আন্তরিক শ্রদ্ধা , ভালাবাসা এবং তাঁর দূরদর্শিতার প্রতি সম্মান।
আজ তাঁর ১৩২তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম। "
কলমে : ঐক্যযোদ্ধা শ্রী সৌম্য চৌধুরী , সদস্য , 'ঐক্য বাংলা' সংগঠন
Comments
Post a Comment