বিমান বসু বললেন, আমি পার্টি থেকে মাসে কত টাকা ভাতা পাই জানো?
মোশারফ হোসেন,কলকাতাঃ নব্বইয়ের দশক। বাংলার রাজনীতির মধ্যগগনে সিপিএম। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী। সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’র দপ্তর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের রাজ্য দপ্তর মুজফফর আহমেদ ভবনেই। আমরা বিভিন্ন কাগজের জনাকয়েক  সাংবাদিক সিপিএম সংক্রান্ত খবরাখবর সংগ্রহ করতে রোজই বিকেলে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ওই অফিসে যাই। ওখানকার সবার কাছেই আমরা মোটামুটি পরিচিত মুখ। নেতারা অনেককে নামে নামেও চেনেন। কে কোন কাগজের রিপোর্টার তাও জানেন। 
একদিন বিকেলে দোতলায় একটি ঘরে বিমান বসুর সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলছি। হঠাৎ আমাদের মধ্যে থেকে একজন আব্দার করে বসল, বিমানদা, কচুরি খেতে ইচ্ছে করছে। আপনি ব্যবস্থা করুন। এমনিতে সাংবাদিকদের আপ্যায়নের ব্যাপারে সিপিএমের তেমন সুনাম ছিল না। অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কেবল বামফ্রন্টের বৈঠক হলে বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে এক কাপ করে লাল চা ও একপিস থিন অ্যারারুট বিস্কুট বরাদ্দ হত। তবে, চারতলায় গণশক্তি দপ্তরে কর্মীদের জন্য রোজই বড় ঠোঙা ভরে মুড়ি-বাদাম-বাতাসা বা এরকম কিছু হালকা টিফিন আসত। সেখানে গেলে দপ্তরের কর্মী না হয়েও আমরা অনেকেই তাতে ভাগ বসাতাম। সেটা সরকারিভাবে নয়। নেহাতই সৌজন্যের খাতিরে। 
যাই হোক, সেদিন কচুরি খাওয়ানোর আব্দারে দৃশ্যত বেশ বিব্রতই লাগল বিমানবাবুকে। এক সাংবাদিককে উদ্দেশ করে নাম ধরে বললেন, তুমি কত টাকা বেতন পাও?  নিশ্চয়ই.....এর কম নয়? আর, আমি পার্টি থেকে মাসে কত টাকা ভাতা পাই জানো? যা পাই তাতে তোমার সাতদিনের কেবল হাত খরচটুকুও হবে না। আমি কী করে তোমাদের সবাইকে কচুরি খাওয়াবো! বিমানবাবুর গলায় কৌতুকের সুর।
ঠিক সেই সময় ঘরে ঢুকলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিমানবাবু বললেন, এই দ্যাখো এরা আমার কাছে কচুরি খেতে চাইছে। কী করি বলোতো! আমার এত টাকা কোথায়! চেয়ারে বসতে বসতে বুদ্ধদেববাবু বললেন, ওহ, এই কথা! দাঁড়ান দেখছি কী করা যায়। নিজেই বারান্দায় বেরিয়ে কাউকে কিছু বললেন। একটু বাদেই সবার জন্য গরম কচুরি এসে পৌঁছল। সঙ্গে রসগোল্লা। খাওয়া হল একসঙ্গে।    
বছরখানেক বাদে একদিন পয়লা বৈশাখে বিমানবাবুর উদ্যোগে আলিমুদ্দিনের দোতলায় সাংবাদিকদের জন্য ঢালাও ফুচকার ব্যবস্থা হল। সঙ্গে পেল্লাই সাইজের অমৃতি। বিমানবাবু বললেন, ভয় নেই, সবাই ফুচকা খেতে পারো। তেঁতুলের জলটা মিনারেল ওয়াটার। সেসময় বোতলবন্দী জলকে মিনারেল ওয়াটার বলার চল ছিল। সাংবাদিকদের প্রায় সবাইই তৃপ্তি করে ফুচকা আর অমৃতি খেলেন। 
খাওয়াদাওয়া মিটতে এক সাংবাদিক বললেন, আচ্ছা বিমানদা, এত কিছু থাকতে আপনি আজ আমাদের ফুচকা খাওয়ালেন কেন? মিটিমিটি হাসলেন বিমানবাবু। তারপর বললেন, আসলে কী জানো, সেদিন বিকেলে মৌলালির মোড়ে দাঁড়িয়ে অজন্তার (অনিল বিশ্বাসের কন্যা) সঙ্গে ফুচকা খাচ্ছিলাম। ওইপথে কলেজ থেকে ফিরছিল সুচেতনা (বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কন্যা)। আমাদের দেখেছে। পরে ফোন করেছিল। বলল ওকেও ফুচকা খাওয়াতে হবে। তাই আজকে ওদের দু’জনকে ডেকেছিলাম। ভাবলাম, পয়লা বৈশাখের দিন। তোমরাও খাও। 
আমাদের অনেকেরই জানা ছিল, বিমানবাবু নিজে খান একবেলা। তাও খাবারদাবার নেহাতই সামান্য। সাদামাটাও। সেদিনও উনি ফুচকা বা অমৃতি ছুঁয়েও দেখলেন না।
                      *                        *                      *  
সম্ভবত ২০০০ সাল। কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে একটি এলাকায় বিমানবাবুদের একটা কর্মসূচি ছিল। সেখানে আমি গিয়েছিলাম অনেকটাই ব্যক্তিগত কাজে। বিমানবাবুর সঙ্গে দেখা হল। কথায় কথায় বললাম, বিকেলে কলকাতায় ফিরব। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বিমানবাবুর দলের মন্ত্রী, অফিসার ও অন্যান্যরা রওনা হয়ে গিয়েছেন। অমি ধীরসুস্থে এগোচ্ছি। সঙ্গে গাড়ি নেই। জানি নিজের মতো ফিরব। তাড়াহুড়ো নেই। হঠাৎ দেখি অন্ধকারের মধ্যেই বিমানবাবুর গাড়ির ড্রাইভার আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। বললাম, কী ব্যাপার? আপনারা এখনও যাননি! বললেন, কী করে যাবো? উনি তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি তাই আপনাকে খুঁজতে এসেছি। চটপট আসুন। 
কোনও বাক্যব্যয় না করে সাদা অ্যাম্বাসাডরে চড়ে বসলাম। পার্টির গাড়ি। অনেকট পথ। তার ওপর জাতীয় সড়কে যানজট। কলকাতায় পৌঁছতে ঘণ্টাতিনেক লেগে গেল। গাড়িতে কত রকমের গল্প করলেন বিমানবাবু। ছেলেবেলার কথা। নিজেদের পরিবারের লোকজনের কথা। পার্টির জন্য পরিবার ত্যাগ। হোলটাইমার হওয়া। কংগ্রেস আমলের অভিজ্ঞতা। ১৯৭৭ এ বামফ্রন্টের ক্ষমতায় আসার দিনটির স্মৃতি। বললেন, কংগ্রেস জমানায় একবার আন্দোলন করতে গিয়ে এক পুলিশ অফিসারের অন্যায় মারধরের শিকার হয়েছিলাম। কয়েক বছর বাদে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরদিনই সেই অফিসার ভদ্রলোক সটান আমার সামনে হাজির। একেবারে পায়ে পড়ে গেলেন। বললাম, আরে করছেন কী! অফিসার বললেন, স্যার সেদিনের কথাটা মনে রাখবেন না প্লিজ! মাফ করে দিন। 
আগেই শুনেছিলাম, অকৃতদার বিমানবাবু নিজের জামাকাপড় নিজেই কাচেন। প্রতিদিনই শুভ্র তকতকে ধুতি-পাঞ্জাবি। ইস্তিরি করা। প্রাণখোলা মানুষটি সেদিন কথায় কথায় বলে ফেললেন, এককালের এক কলেজ সহপাঠী আমেরিকায় থাকেন। তিনি বছরে একবার কলকাতা ঘুরে যান। প্রতিবার তিনিই বিমানবাবুকে ধুতি, পাঞ্জাবি, পাজামা কিনে দিয়ে যান। বললেন, এবার অনেকদিন হল সেই বন্ধু আসেনি। এদিকে, পাজামাগুলো ছিঁড়ে যেতে বসেছে। বড্ড চিন্তায় পড়েছি। দেখি কী করা যায়! 
কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। ধনী পরিবারের সন্তান। মানুষের কল্যাণে সর্বস্ব ত্যাগ করে পথে নেমেছেন। রাজ্যের শাসকদলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা। যে দলের নাম ভাঙিয়ে কত এলি তেলি জমিদার বনে গেল, চুনোপুঁটিরা হয়ে গেল রাঘব বোয়াল, সেই দলের এক নেতার জীবনধারা এই! কমিউনিস্ট ধারণাটা এখনও মরে যায়নি এই মানুষগুলোর জন্যই। 
খুব ইচ্ছে করছিল বলি, বিমানদা, যদি কিছু মনে না করেন আমি আপনার জন্য দু-এক প্রস্থ পোশাক কিনে দেব? কিন্তু বলতে পারলাম না। গলায় আটকে গেল। মনে হল, কে জানে, বিষয়টিকে উনি যদি আমার ধৃষ্টতা বলে ভাবেন!  
জন্মদিনে বিমানদা’র প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর নীরোগ দীর্ঘজীবন কামনা করি।

Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গ গৌরব উৎসব সম্মান পেলেন মৌসুমী দাস

বেলঘরিয়া থানার পুলিশের উদ্যোগে উদ্বার বেআইনি একাধিক স্কুটি

সমাজ সেবা করাই নেশা নীলকণ্ঠের