দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবি ও লেখক । তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারি ছিলেন । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাংলায় স্বরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা-নেতা ছিলেন তিনি । ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়কালে তাঁর নাম সংক্ষেপে সি আর দাশ নামে সমধিক পরিচিত ছিলো। তিনি অন্যায় কে কখনো সহ্য করতেন না, আর অসহায় দীন দারিদ্রের প্রতি তাঁর দয়ার অন্ত ছিলো না । তৎকালীন সময়ে বৃহৎ অঙ্কের আয় অর্জনকারী উকিল হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে বাংলার ইতিহাসে দানবীর হিসাবে সুপরিচিত হয়ে আছেন । তিনি "দেশবন্ধু" নামেতে জগৎ বিখ্যাত হয়ে আছেন।
"এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।।"
জন্ম: ৫ ই নভেম্বর, ১৮৭০ সাল, কলকাতা
মৃত্যু:১৬ ই জুন,১৯২৫ সাল, দার্জিলিং
চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৮৭০ সালের ৫ ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের তেলিরবাগে ।একটি সুপরিচিত বৈদ্য ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । বিক্রমপুরের বহু শতাব্দী ধরে দীর্ঘ ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল রয়েছে । দ্বাদশ শতাব্দীতে এটি বল্লাল সেনা এবং লক্ষণ সেনার রাজধানী ছিল, সেন রাজবংশের রাজা এবং তখন থেকেই পূর্ব ভারতের জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল । দাস পরিবার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সদস্য । চিত্তরঞ্জন ছিলেন ভুবন মোহন দাসের ছেলে এবং ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের ভাগ্নে । তাঁর বাবা ছিলেন সলিসিটার এবং সাংবাদিক, যিনি ইংরেজি গির্জার সাপ্তাহিক ব্রাহ্মো পাবলিক মতামত সম্পাদনা করেছিলেন।
ভুবন মোহন দাস কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাটর্নি ছিলেন । ধনী পরিবারের হয়েও খুব সহজ সরল সাধারণ জীবনযাপন করতেন । আইনজ্ঞের সাথে সাথে সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবেও খ্যাতি ছিলো তার । সকলকে গান শুনিয়ে মুগ্ধ করত । বাবার সমস্ত গুন লক্ষ্য করতেন চিত্তরঞ্জন । বাবার চরিত্রের ছাপ চিত্তরঞ্জনের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিলো ।চিত্তরঞ্জনের মা নিস্তারিণী দেবী কাউকে খালি হাতে ফিরতেন না । অনেক মানুষকে তিনি বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করতেন । ১৮৮৬ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় সফল হন । তার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন । তারপর বাবা তাকে আই. সি. এস পড়ার জন্যে বিলেতে পাঠান । সেখানে সে ক্রমশ পরিচিতি লাভ করেন । সেখানে প্রবাসী ভারতীয় আন্দোলনে যোগ দেন । বিলেতের নানা কাজে জড়িয়ে পড়ায় তার পক্ষ্যে আই. সি. এস পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। কিন্তু ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন।তাঁকে সম্মানিত করা হয় দেশবন্ধু বলে, যার অর্থ "জাতির বন্ধু"। তিনি বেশ কয়েকটি সাহিত্য সমিতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং অসংখ্য নিবন্ধ, প্রবন্ধ গুলি বাদেও অনেক কবিতা লিখেছিলেন । তিনি বাসন্তী দেবীকে বিবাহ করেছিলেন এবং তাঁর তিন সন্তান হল অপর্ণা দেবী , চিররঞ্জন দাস এবং কল্যাণী দেবী । বাসন্তী দেবীও স্বাধীনতা আন্দোলনে নেমেছিলেন এবং ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর ভগ্নিপতি উর্মিলা দেবীর সাথে আদালতে গ্রেপ্তারের প্রথম মহিলা হলেন তিনি । সবার প্রতি স্নেহ এবং ভালবাসা ছিল অপরিসীম ।তিনি সকলের কাছে মাতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন । নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁকে 'মা' হিসাবে সম্বোধন করতেন।চিত্তরঞ্জন দাস অনুশীলন সমিতির কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন । যখন জাতির উদ্দেশ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত শত শত তরুণ আগুনের দল তৈরির জন্য সমিতির সভাপতি হিসাবে সমিতিকে সংগঠিত করেছিলেন, তখন চিত্তরঞ্জন তাঁর সহযোগী হয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাস (১৮৯৪), হরিদাস বোস (১৮৯৯), সুরেন হালদার (১৯০০) এবং জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায় (১৯০১) এর সহায়তায় অনুশীলন সমিতি রক্ষণাবেক্ষণ দায়িত্ব ভার সামলেছিলেন । ১৯২০ খ্রিঃ ৪ ঠা সেপ্টেম্বর কংগ্রেসের সম্মেলন । চিত্তরঞ্জনের জীবনে সে এক স্মরণীয় দিন । ঘরছাড়া দেবতার ডাকে তিনি পা বাড়ালেন । নাগপুরের এই অধিবেশনে তার সঙ্গে মাহাত্মাজীর দেখা হল । উভয়ের এই পরিচয় তার জীবনে এক পরিবর্তন আনল । তিনি যখন কলকাতার বাড়িতে ফিরলেন তখন তার মনে এক অপরূপ ভাব । অর্থ , যশ , ক্ষমতা সব কিছুরই যেন তার কাছে মূল্যহীন । তিনি দেশ সেবায় নিজেকে ও নিজের সবকিছু উৎসর্গ করতে লাগলেন ।
চিত্তরঞ্জন দাস একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, যখন তিনি জাতীয় আন্দোলনের ঝামেলার সময়ে, তাঁর "অন্তর্যামী" "মালঞ্চ" এবং "মালা" শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি "সাগর সংগীত" বা সমুদ্রের গান প্রকাশ করেছিলেন।
চিত্তরঞ্জন "নারায়ণা" নামে একটি মাসিক জার্নাল শুরু করেছিলেন সেখানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিন চন্দ্র পাল এবং হরিপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো অনেক প্রখ্যাত লেখক তাদের লেখায় ভরিয়ে রেখেছিলেন ।১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জনের স্বাস্থ্য অতিরিক্ত কাজের কারণে খারাপ হতে শুরু করে । সঠিক চিকিৎসার জন্যে চিত্তরঞ্জন ১৯২৫ সালের মে মাসে স্যার এন. এন. সরকারের বাড়িতে দার্জিলিং গিয়ে থেকেছিলেন । মহাত্মা গান্ধী তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং কিছু দিন তাঁর সাথে ছিলেন।
গান্ধীজি লিখেছেন-
"আমি যখন দার্জিলিং ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম তখন আমি আরও অনেক কিছু ভেবে ছিলাম যা আমি আগে কখনও ভাবে ছিলাম। দেশবন্ধুর প্রতি আমার স্নেহে আর এতো মহান আত্মার প্রতি আমার উষ্ণ অনুভূতির কোনও শেষ নেই ।"
দার্জিলিংয়ে ১৯২৫ সালের ১৬ ই জুন ভারতের স্বাধীনতার আকাশের অন্ধকার নেমে এলো দেশনেতার মহা প্রায়নে । ১৯৫০ সালে চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের প্রাঙ্গণে চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয় । তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর আগেই চিত্তরঞ্জন তাঁর বাড়ি এবং পার্শ্ববর্তী জমি সহ এই সম্পত্তি নারীদের জীবনের উন্নতির জন্য ব্যবহার করার জন্য জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন সেখানেই দেশবন্ধুর নামাঙ্কিত চিত্তরঞ্জন সেবাসদন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করলেন...."দীনের বন্ধু, দেশের বন্ধু, মানব বন্ধু তুমি,
চেয়ে দেখ আজ লুটায়ে বিশ্ব তোমার চারণ চুমি। "
আজ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ৯৬ তম মৃত্যু দিনে জানাই শ্রদ্ধা ও প্রণাম
Comments
Post a Comment