বিপ্লবী রাসবিহারী বসু



কখনও তাকে দেখা যেত এক শিখ পাঞ্জাবি ভদ্রলােকের বেশে ,মাথায় পাগড়ি ,মুখে চাপদাড়ি। কখনও তিনি শেরওয়ানি চোস্ত পরা উর্দুভাষী আফগান।কখনও বা কোট হ্যাট পরা এক ইংরেজ সাহেব।আবার কখনও কপালে তিলক কাটা মারাঠি ব্রাহ্মণ।


ভাবতে অবাক লাগে,এত দ্রুত ছদ্মবেশ পালটাতেন কী করে ? শুধু ছদ্মবেশ নয় ,তার প্রকৃত নামটাও কতবার পালটাতে হয়েছিল তাকে। তিনি হলেন রাসবিহারী বসু।এক বিচিত্র কর্মোদ্যমী মহান বিপ্লবী।তিনি ছিলেন বিপ্লবীর বিপ্লবী।ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে তার নাম সােনার অক্ষরে লেখা আছে।


জন্ম: ২৫ শে মে, ১৮৮৬ সাল । সুবলদহ, পূর্ব বর্ধমান জেলা।

প্রয়াণ : ২১ শে জানুয়ারী, ১৯৪৫ সাল। টোকিও, জাপান।


রাসবিহারী বসু ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ শে মে জন্মগ্রহণ করেন৷ তার জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷ প্রচলিত মতানুযায়ী, তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলায় অবস্থিত তাঁর পৈতৃক গ্রাম সুবলদহে জন্মগ্রহণ করেন৷ অপর মতানুযায়ী, তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ভদ্রেশ্বরের সন্নিকটস্থ পালাড়া-বিঘাটি গ্রামে তার মাতামহ নবীন চন্দ্র সিংহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর পিতা বিনোদবিহারী বসু এবং তাঁর মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। তিনকড়ি দাসী ছিলেন তাঁর ধাত্রী মাতা৷ তাঁর পিতামহ নাম ছিলেন কালীচরণ বসু৷ এই বসু পরিবারের আদিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বৈঁচীতে৷পরবর্তীকালে এই পরিবার বৈঁচী থেকে প্রথমে হুগলি জেলারই সিঙ্গুরে এবং পরবর্তীকালে পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহে চলে আসে৷ তাঁদের পূর্বপুরুষ নিধিরাম বসুই সর্বপ্রথম সুবলদহে বসবাস শুরু করেন৷


রাসবিহারী বসুকে তাঁর নামটি দিয়েছিলেন পিতামহ কালীচরণ বসু। গর্ভাবতী অবস্থায় তাঁর মা ভুবনেশ্বরী দেবী কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই সুবলদহ গ্রামের পশ্চিম পাড়াতে অবস্থিত বিষ্ণুমন্দির বা কৃষ্ণ মন্দিরে তাঁর নামে মানত করা হয়েছিল যাতে তিনি সুস্থভাবে সন্তানের জন্ম দেন, তাই পরবর্তীকালে তাঁর নাতির নাম রাখেন, কৃষ্ণের অপর নামে। রাসবিহারী হল কৃষ্ণের অপর নাম। রাসবিহারী বসু এবং তাঁর ভগিনী সুশীলা সরকারের শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছিল সুবলদহ গ্রামে। তাঁরা সুবলদহ গ্রামে বিধুমুখী দিদিমণির ঘরে বসবাস করতেন।বিধুমুখী ছিলেন একজন বাল্যবিধবা, তিনি ছিলেন কালিচরণ বসুর ভ্রাতৃবধূ।


রাসবিহারীর পিতামহ কালীচরণ বসু সেকালের এক বিখ্যাত লাঠিয়াল ছিলেন।পিতামহের কাছ থেকে সুস্বাস্থ্য গড়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সেদিনের বালক রাসবিহারী।তারই তত্বাবধানে ও শিক্ষায় অল্প বয়সেই রাসবিহারী ব্যায়াম পুষ্ট সুগঠিত দেহের অধিকারী হয়েছিলেন।বিনােদবিহারী বাস করতেন সিমলাতে।পরবর্তীকালে তিনি চলে আসেন চন্দননগরে।চন্দননগরে ফটকগােড়াতে একটি বাড়ি কিনে পাকাপাকিভাবে বাস করতে থাকেন।


সুবলদহ গ্রামের পাঠশালায় রাসবিহারীর প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়।পড়াশুনায় খুব মেধাবী  ছিলেন,মন দিয়ে পড়তেন।খুব একটা বেশি সময় বই মুখে বসে থাকতেন না।পাঠ্য জগতের বাইরে যে বিরাট প্রকৃতি আছে ,সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করতেন। সহপাঠীদের সাথে প্রাণ খুলে মিশতেন।ধনী দরিদ্র ভেদাভেদ করতেন না।সম্প্রদায়গত সংস্কার ছিল না রাসবিহারীর মনের মধ্যে ।উদারচেতা মনােভাবের বালক ছিলেন তিনি ।চন্দননগরে এসে ভরতি হলেন ডুপ্লে কলেজে ।বর্তমানে এই কলেজের নাম ।চন্দননগর গভর্নমেন্ট কলেজ । এখানকার পরিবেশ তাকে আরও পালটে দিল ।মেধাবী ছাত্র হিসেবে সুনাম অর্জন করলেন ।প্রত্যেকটি শাখায় ছিল তার গভীর অনুরাগ ।সাহিত্য এবং দর্শন একই সঙ্গে পড়েছেন। মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বিশিষ্ট মনীষীদের লেখা নিয়ে আলােচনা করতেন ।


একদিন ইতিহাস ক্লাসে শিক্ষক মহাশয়ের পড়ানাে শুনে রাসবিহারীর বিরূপ হয়ে ওঠে।ইতিহাসের শিক্ষক বলেছিলেন — মাত্র চোদ্দোজন ঘােড়সওয়ার এসে গৌড়রাজের রাজধানী অধিকার করে নিয়েছিল । সেদিনের সদ্য কিশাের রাসবিহারী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন।সহপাঠীরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে,তাদের বুক দুরু দুরু করে কাপছে ।এই বুঝি রাসবিহারীকে শাস্তি পেতে রাসবিহারী দৃঢ়স্বরে বললেন - স্যার , আপনার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে আমি বাধ্য হচ্ছি।একটি সুরক্ষিত রাজধানী এবং রাজপ্রাসাদ মাত্র চোদ্দোজান ঘােড়সওয়ারের পক্ষে কখনােই অধিকার করা সম্ভব নয়,এটি হল ইতিহাসের এক মারাত্মক বিকৃততথ্য । এইভাবে বিকৃত ইতিহাস পড়ানাে উচিত নয় ।শিক্ষক মশাই অবাক হলেন।বারবার তিনি এই কথাই পড়িয়েছেন , বিভিন্ন ক্লাসে।কেউ কখনও প্রতিবাদ করতে সাহস করেনি,আর এই ছেলেটি কিনা আমার মুখের ওপর জবাব দেবার চেষ্টা করছে ? শিক্ষক মশাই ক্রোধে ফেটে পড়লেন।রাসবিহারীকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছিল।শেষ অব্দি বিরক্ত হয়ে রাসবিহারী স্কুল ত্যাগ করলেন।ভাবলেন ,এই প্রথাগত শিক্ষা লাভ করে কোনাে লাভ নেই। তখন চন্দননগরে একাধিক বিপ্লবী লুকিয়ে থাকতেন।কারণ চন্দননগর ছিল ফরাসিদের শাসনাধীন অঞ্চল।এখানে ব্রিটিশের নিয়মনীতি বা আইন কানুন কাজ করত না।তবে ছদ্মবেশে ব্রিটিশ গুপ্তচররা চন্দননগরে ঘুরে বেড়াত।এখানে এসে। আশ্রয় নিয়েছিলেন বিখ্যাত বিপ্লবী চারু রায়।রাসবিহারী তার সংস্পর্শে এলেন,চারু রায়কে দেখে মনে হল এই ব্যক্তির মধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লুকিয়ে আছে।চোখ দুটিতে আছে অতনাপ্ত গভীরতা।চারু রায় রাসবিহারীকে রাজনৈতিক মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। তখন থেকে রাসবিহারীর জীবনের ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠল ভারতের স্বাধীনতা।

বাবা বিনােদবিহারী বুঝতে পারলেন ,স্থান পরিবর্তন করতে হবে।ছেলের আচার আচরণ মােটেই ভালাে লাগছে না তার।রাসবিহারীকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল,হিতে বিপরীত হল ।কলকাতা তখন বিপ্লবের অগ্নিকেন্দ্র ।বাতাসে বারুদের গন্ধ। আকাশে প্রতিবাদের ঝড়।


রাসবিহারীকে মর্টন কলেজে ভরতি করা হল।এখানে পড়াশুনা করার সময় রাসবিহারী একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেন।তখনকার দিনে বাঙালিদের সেনা বাহিনীতে নেওয়া হত না ।বাঙালি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নয় ,ভীরু স্বভাবের — এমন অনেক অপবাদ দেওয়া হত।

 রাসবিহারী কিন্তু অভিভাবকদের অনুমতি না নিয়ে সৈন্যবিভাগে ভরতি হওয়ার জন্য আবেদন করলেন।রাসবিহারীর স্বপ্ন ছিল শিবাজীর আদর্শকে সামনে রেখে এক সেনাবাহিনী গঠন করবেন এবং সেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন।ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। দেশকে ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে মুক্ত করবেন। সৈন্য বিভাগে ভরতি হওয়ার জন্য তিনি একটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন।নিজেকে অবাঙালি বলে পরিচয় দিয়েছিলেন,ধরা পড়ে গিয়ে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল তাকে।এবার পিতা পুত্রকে আর বাংলাদেশে রাখতে রাজী হলেন না।তিনি ছেলেকে নিয়ে এলেন সিমলাতে।বাংলা থেকে অনেক দূরে সিমলা একটি শান্ত শৈল শহর। চারপাশে ব্রিটিশ ভাবধারা প্রবাহিত।এখানে এলে ছেলের মন পরিবর্তন হবে পিতা তাই ভেবেছিলেন।রাসবিহারী আর পড়াশনা করতে রাজী হলেন না।শেষ পর্যন্ত নিরুপায় বিনােদবিহারী কিশাের পুত্রকে সিমলার সরকারি প্রেসের কাজে ঢুকিয়ে দিলেন।রাসবিহারীর কাজ ছিল কপি ধরে রাখা।এই কাজ করতে সেদিনের সদ্য কিশাের রাসবিহারীর মােটেই ভালাে লাগত না।কিন্তু কী করবেন ? বাবাকে তিনি যমের মতাে ভয় করতেন ।বাবার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেননি ।নিরুপায় হয়ে রাসবিহারী প্রেসের কাজ করলেন। এই সময় তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। মন দিয়ে ইংরাজি ভাষা শিখেছিলেন। শিখেছিলেন টাইপ রাইটিং ও শর্ট হ্যাণ্ড।

তখন কিছু সরকারী গােপন নথিপত্র ওই প্রেসে ছাপা হত  রাসবিহারীর সঙ্গে এক ইংরাজি পত্রিকার সম্পাদকের পরিচয় ছিল।সম্পাদকের অনুরােধে রাসবিহারী গােপন তথ্যের বেশ কিছু অংশ তার হাতে তুলে দিলেন।স্থানীয় কাগজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হল। সরকারী মহলে হৈ হৈ পড়ে গেল। বিনােদবিহারী জানতেন এটা তার ছেলের কাজ। তিনি প্রেসের কাজ থেকে রাসবিহারীকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন।

 তখন দিন কাটছে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে।সদ্য তরুণ রাসবিহারী ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারছেন না।বেশ কিছুদিন কেটে গেল এইভাবে। দেরাদুনের বনবিভাগে রাসবিহারী নিজের উদ্যোগে একটি চাকরি জোগাড় করলেন।তখন তার মনােজগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে।ভারতের বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন।জেগে উঠল ঘুমন্ত রাজনৈতিক সত্তা।উত্তর ভারতে বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করার কাজে মন দিলেন।বাল্যবন্ধু এবং বৈপ্লবিককর্মী শ্ৰীশচন্দ্র ঘােষ ও প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল রায়ের সঙ্গে আলােচনা হল।যােগাযােগ হল মহাবিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় অর্থাৎ বাঘ।যতীনের সঙ্গে বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে বাঘাযতীন তখন নিজেকে বাংলাদেশের জননেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার পরামর্শে রাসবিহারী উত্তর ভারতে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তােলার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।


ইতিমধ্যে চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে।চন্দননগরে এসে চারু রায়ের বিপ্লব সমিতি সুহৃদ সম্মেলনে যােগাযােগ করলেন।দেরাদুনে নিয়ে গেলেন বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাসকে।রাসবিহারী ছিলেন এক দক্ষ সংগঠক।ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে ঘুরে তরুণদের চিহ্নিত করতেন,তাদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিতেন।তার তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ের মধ্যে লাহাের , অমৃতসর , মিরাট , দিল্লি , বােম্বাই , মাদ্রাজে বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপিত হল।সব বিপ্লবী একবাক্যে রাসবিহারীকে নেতা হিসেবে স্বীকার করে নিলেন। এ যাবৎকাল কলকাতা ছিল সমগ্র ভারতের রাজধানী।১৯১২ সালে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পাকা ব্যবস্থা হয়ে গেলো।

রাসবিহারী অনেকগুলি দুঃসাহসিক অভিযানে দিয়েছেন।তার নেতৃত্বে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর আক্রমণ করা হয়। দিল্লির চাদনিচকে ভাইসরয়ের শােভা যাত্রায় বসন্ত বিশ্বাসের ছোঁড়া বােমায় হার্ডিঞ্জ আহত হলেন।জনতার হৈ হট্টগোলের মধ্যেই বসন্ত ও রাসবিহারী সাবলীল ভাবে গা ঢাকা দিয়ে কর্মস্থল দেরাদুনে ফিরে গেলেন।বিপ্লবী সহকর্মীরা পর্যন্ত রাসবিহারীর আসল পরিচয় জানতেন না।বেশির ভাগ জায়গায় তিনি দরবারি সিং ও সতীশচন্দ্র নামে পরিচিত ছিলেন।


একবার তিনি কলকাতায় এলেন।বেলেঘাটার ঘাটিতে থাকবেন ,এই ব্যবস্থা করা হল।পুলিশ আগে থেকেই সন্ধান পেল।পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজল,কিন্তু কোথাও রাসবিহারীকে পাওয়া গেল না ।অনেকের চোখে পড়ল,রাস্তার পাশের বাড়ির বারান্দায় এক অ্যাংলাে ইণ্ডিয়ান বৃদ্ধ আপন মনে বেহালা বাজিয়ে চলেছে ।ঝানু গােয়েন্দা কর্তারা বুঝতেই পারেনি যে , এই বৃদ্ধ হলেন রাসবিহারী বসু ।এভাবেই তিনি বারবার ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলাে দিয়েছেন।


ইতিমধ্যে ইওরােপে শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

ভারতবর্ষে তার আঁচ পড়ল।রাসবিহারী বৃহত্তর পরিকল্পনা রূপায়নের চেষ্টা করলেন।এগিয়ে এলেন বিপ্লবী নেতা পিংলে , হরদয়াল , শচীন সান্যাল , যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী এবং মানবেন্দ্রনাথ রায়। কয়েকজন দেশদ্রোহীর বিশ্বাসঘাতকতায় এই পরিকল্পনা সফল হল না।পরিনামে বহু সংখ্যক দেশপ্রেমিক সিপাহী ও বিপ্লবীকে ফাঁসি কাঠে ঝুলতে হল। কার্তার সিং,বিষ্ণুগনেশ পিংলে, হরনাম সিং প্রভৃতির ফাসি হল।তবু রাসবিহারী বিন্দুমাত্র হতাশ হলেন না।তিনি ছিলেন চরম বাস্তববাদী মানুষ।তিনি জানতেন,বিফলতার সোপান পার হয়ে সফলতার শিখরে উঠতে হয়।

কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করে রাসবিহারী চলে এলেন বাংলায়।নতুন করে পরিকল্পনা শুরু হল।পুলিশ তার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।সহযােগী বন্ধুরা তাকে দেশত্যাগ করতে বললেন।তিনি তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে পি . এন ঠাকুর ছদ্মনামে জাহাজে উঠলেন। পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের কাছে এই খবর পৌঁছে গেছে।তিনি সশস্ত্র সেপাই নিয়ে জাহাজে তল্লাশি শুরু করলেন।পি এন ঠাকুরের কেবিনের সামনে এলেন।রাসবিহারী তখন বই পড়তে পড়তে সিগারেট টানছিলেন।টেগার্ট বুঝতেই পারলেন না।এভাবে রাসবিহারী দেশের বাইরে চলে গেলেন।


জাপানের কোবে বন্দরে অবতরণ করলেন।সেখানে শুরু হল তার অন্য জীবন।সেখান থেকেই ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম টোকিও ইণ্ডিয়ান লীগ  চালিয়ে  গেলেন।বিপ্লবীদের হাতে নিয়মিত অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে লাগলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল।রাসবিহারী শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করলেন।ইংরাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।স্থাপিত হল আজাদ হিন্দ সংঘ।১৯৪২ সালের ১৫ জুন ,ব্যাঙ্ককে একটি বিরাট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল।রাসবিহারীকে ওই সংঘের প্রধান পদে বসানাে হল।সভাপতি হলেন ক্যাপ্টেন মােহন সিং। কিছুদিন বাদে সুভাষচন্দ্র গােপনে ভারত ত্যাগ করে মস্কো হয়ে বার্লিনে উপস্থিত হলেন।অস্থায়ীভাবে সূচনা করলেন স্বাধীন ভারত সরকারের।তারপর রাসবিহারীর সঙ্গে সুভাষের ফোনে কথা হল । ১৯৪৩ সালের ২ রা জুলাই সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে উপস্থিত হন  এবং ৪ ঠা জুলাই  রাসবিহারী তার আজাদহিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার অর্পণ করেন।পরে আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হলে তিনি মন্ত্রিসভার সর্বোচ্চ পরামর্শদাতার পদ অলংকৃত করেন।রাসবিহারী ভারতবর্ষ সম্পর্কে জাপানী ভাষায় পাঁচখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।ডাঃ স্যাণ্ডারল্যাণ্ডের ইণ্ডিয়াইন বণ্ডেজ গ্রন্থ জাপানী ভাষায় অনুবাদ করেন।


জাপানে সোমা নামে এক পরিবার তাকে আশ্রয় দেয়।রাসবিহারী বসু ও তার স্ত্রী তোশিকো বসু সোমা 

জাপানে অবস্থানকালে ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দের ৯ জুলাই রাসবিহারী বসু জাপানি সোমা পরিবারের কন্যা তোশিকো সোমাকে গোপনে বিবাহ করেন৷তাদের দুই সন্তানের নাম হল তেৎসুকো হিগুচি বসু ও মাশাহিদে বসু (ভারতীয় নাম ভারতচন্দ্র)৷মাশাহিদের জন্ম ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট ও তেৎসুকোর জন্ম ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মাত্র ২৪ বছর বয়সে যুদ্ধক্ষেত্রে মাশাহিদের মৃত্যু ঘটে।


সমগ্র এশিয়ার মহান বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসু ২১ জানুয়ারি ১৯৪৫ খ্রীঃ টোকিওতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।মৃত্যুর কিছুদিন আগে রাসবিহারী বসুকে জাপান সরকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘সেকেন্ড অর্ডার অব দি মেরিট অব দি রাইজিং সান’ খেতাবে ভূষিত করে।

১৯৬৭ সালের ভারতীয় ডাকটিকিটে রাসবিহারী বসু

১৯৬৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার তার স্মৃতিরক্ষার্থে ৩.৩৪ X ২.৪০ সেন্টিমিটারের একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।


রাসবিহারী বসুর দুর্ভাগ্য,জীবনের বেশির ভাগ সময় তাকে দূর প্রবাসে থাকতে হয়েছে।ভারতীয় বিপ্লবের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন।তা সত্ত্বেও তিনি বিন্দুমাত্র হতাশ হয়ে পড়েননি।জাপানে গিয়ে ভারতীয় বিপ্লবীদের সাহায্য করেছেন।নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী তুলে দিয়েছেন।রাসবিহারীকে আমরা সর্বাত্মক বিপ্লব সাধক বলতে রাসবিহারী বসুর মতাে দৃঢ়চেতা বিপ্লবীদের ঐকান্তিক সাধনার ফলেই ভারতবর্ষ তার ঈপ্সিত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।আমাদের দেশে বিপ্লবীমহানায়ক রূপে তিনি ভারতবাসীর মনমন্দিরে শ্রদ্ধার আসনে চির জাগরিত রয়েছেন।


আজ বীর বিপ্লবীর জন্ম দিবসে আমরা শ্রদ্ধা ও প্রণাম 

সন্দীপ চক্রবর্ত্তী

ব্যবত্তারহাট 🌼নন্দকুমার 🌼পূর্ব মেদিনীপুর

Comments

Popular posts from this blog

বঙ্গ গৌরব উৎসব সম্মান পেলেন মৌসুমী দাস

বেলঘরিয়া থানার পুলিশের উদ্যোগে উদ্বার বেআইনি একাধিক স্কুটি

সমাজ সেবা করাই নেশা নীলকণ্ঠের